বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি বরিশাল আঞ্চলিক শাখার গৌরব ও গর্বের ইতিহাস

  • আপডেট টাইম : নভেম্বর ১২ ২০২০, ০৫:০০
  • 1336 বার পঠিত
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি বরিশাল আঞ্চলিক শাখার গৌরব ও  গর্বের ইতিহাস
সংবাদটি শেয়ার করুন....

বৃহত্তম বরিশালের সমৃদ্ধ ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি বরিশাল আঞ্চলিক শাখা। বরিশালের যাবতীয় কর্মকান্ডের সংগে এই সংগঠনটি সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে আছে। বিশাল ভবন এ সংগঠনের গৌরবের বড় পরিচয় নয়। কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে এই সংগঠনটি শুধু শিক্ষক নয়, নাগরিক সমাজের মধ্যেও নিজস্ব পরিচিতি ও ভালবাসা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। শিক্ষকদের পেশাগত দাবি দাওয়ার সংগ্রামের পাশাপাশি বরিশালের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও উন্নয়নের বিস্তৃত ক্ষেত্র জুড়ে রয়েছে সংগঠনটির অসামান্য অবদান।
বরিশালের শিক্ষার ঐতিহ্য ও ইতিহাস সমৃদ্ধশালী। মহাত্মা অশ্বিনী দত্তকে বরিশালে শিক্ষা প্রসারের অগ্রদূত বলা হয়। সত্য, প্রেম, পবিত্রতার মহৎ আদর্শ নিয়ে সর্ব সাধারণের মধ্যে আধুনিক শিক্ষা প্রসারের উদ্যোগ হিসেবে তিনি প্রথমে বি.এম. স্কুল এবং অল্প সময়ের ব্যবধানে বাংলার অক্সফোর্ড খ্যাত বি.এম. কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। মহাত্মার এই শিক্ষা জাগরণের উদ্যোগের পথ ধরেই বাংলার অবহেলিত উৎপীড়িত জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষার আলো জ্বালালেন বাংলার কৃতি সন্তান কৃষক কুলের চিরবন্ধু মরহুম শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক। ধীরে ধীরে মফ:স্বল অঞ্চলেও আধুনিক শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়ে।
শিক্ষার সমৃদ্ধ ইতিহাসের সঙ্গে সমানভাবে জড়িয়ে আছে এই শিক্ষক সংগঠনটির নাম। এ ইতিহাস শতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাস। অবিভক্ত ভারতে ১৯২১ সালে অইঞঅ (অল বেঙ্গল টিচার্স এসোসিয়েশন) নামে সংগঠনির জন্ম। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ঊচঞঅ (ইস্ট পাকিস্তান টিচার্স এসোসিয়েশন) এবং ১৯৭১ সালে মার্চের অসহযোগ আন্দোলন চলাকালেই এই সংগঠনের নাম পরিবর্তিত হয়েÑ হয় ইঞঅ অর্থাৎ বাংলাদেশ টিচার্স এসোসিয়েশন। ব্রিটিশ ভারতের অইঞঅ থেকেই বর্তমানের ইঞঅ বা বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি। বরিশালে ইংরেজ আমল থেকে বি.এম. স্কুল রোডের টিনের ঘরে এ সংগঠনের বরিশাল আঞ্চলিক শাখার কার্যালয় ছিল। শিক্ষকদের সদস্য চাঁদা, সংগঠনের শাখাসমূহ এবং শুভানুধ্যায়ীদের অনুদানে সংগৃহীত অর্থ দিয়ে ১৯৯০ সালে ফকির বাড়ি রোডে ডা. এন. আহমদের স্ত্রীর নিকট থেকে একটি দ্বিতল ভবনসহ জমি খরিদ করে নির্মিত হয় বর্তমান শিক্ষক ভবন। ১৯৯৮ সালে ২৫ জুন দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নের রূপকার তৎকালীন চীফ হুইফ আলহাজ্ব আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ শিক্ষক ভবন’ এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই শিক্ষার সোনালী দিনের সব খ্যাতিমান শিক্ষক বরিশালে এই সংগঠনের সংগে যুক্ত ছিলেন। বি.এম. স্কুলের স্বনামধন্য প্রধান শিক্ষক প্রয়াত জগদীশ মুখার্জী, জয়ন্ত দাশগুপ্ত ছাড়াও যোগেশ চ্যাটার্জি (ননী বাবু), সতিপদ ঘোষ, অম্বিকা সরখেল, প্রাণ কুমার সেন (সারস্বত স্কুলের প্রধান শিক্ষক) প্রমুখ প্রথিতযশা শিক্ষকগণ যুক্ত ছিলেন এই সংগঠনের সঙ্গে।
তবে সামপ্রদায়িক ভিত্তিতে দেশ ভাগের ফলে বিশেষ করে ১৯৫০ এর ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে এই সংগঠনের কার্যক্রম ৩ থেকে প্রায় ৪ বছর বন্ধ ছিল। বাকেরগঞ্জ ডিষ্ট্রিক্ট টিচার্স এসোসিয়েশন ইউঞঅ এই নামে ১৯৫৩ সালে সম্মেলনের মাধ্যমে পাকিস্তান আমলে বরিশাল শিক্ষক সমিতির নতুন যাত্রা শুরু হয়। এই সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এদেশে সমবায় আন্দোলনের নন্দিত প্রথিকৃত দেশের কৃতি সন্তান মরহুম আক্তার হামিদ খান। প্রথম সম্মেলনে সেক্রেটারী হন শ্রদ্ধেয় জয়ন্ত দাশ গুপ্ত এবং পরবর্তীতে প্রখ্যাত গণিত শিক্ষক অম্বিকা সরখেল। নব উদ্যমে যাত্রা শুরুর এই পর্যায়ে সংগঠনের কান্ডারী হিসেবে হাল ধরেন মেধাবী মুসলিম যুবক এম.এ. গফুর। তার ছিল রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা। এক সময় তিনি ছিলেন মুসলিম লীগের তরুন নেতা। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বাঙালিদের প্রতি বঞ্চনা ও অবহেলার মনোভাব প্রকট হয়ে ওঠে। বিশেষ করে বাংলা ভাষার মর্যাদা দিতে পাকিস্তানী শাসক-গোষ্ঠীর অস্বীকৃতির ফলে সৃষ্ট ভাষা আন্দোলন মুসলিম লীগের প্রতি এম.এ. গফুরের মোহমুক্তি ঘটায়। অসাম্প্রদায়িক চেতনা সম্পন্ন বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতাদের সংস্পর্শে এসে এম.এ. গফুরের চেতনা জগতে বিপ্লব ঘটে। পূর্ব থেকেই সাংগঠনিক অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ উদ্যমীএ তরুন শিক্ষক হয়ে ওঠেন শিক্ষকদের আকর্ষণের কেন্দ্র বিন্দু। এ পর্যায়ে তাঁর সংগে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন সে সময়ের সব প্রতিভাবান শিক্ষক। যাঁদের মধ্যে ছিলেন শ্রদ্ধেয় হোসেন আলী, নিখিল সেন, প্রশান্ত দাশগুপ্ত, নিরোদ বিহারী নাগ, আব্দুল কাইউম, নিহার চক্রবর্তী, বাউফলের দেলোয়ার হোসেন, স্বরূপকাঠীর জগদীশ আইচ সরকার, অজিত বিশ্বাস, জহিরুল হক লাল মিয়া ও নূরুদ্দিন মিয়া, বাকেরগঞ্জের বিজয় ব্যানার্জী মহিলাদের মধ্যে মঞ্জুশ্রী সেন ও রাণী ভট্টাচার্য প্রমুখ। অল্প কিছু শিক্ষকের ক্ষুদ্র সংগঠন তাঁর নেতৃত্বে বৃহত সংগঠনে পরিণত হতে থাকে। একে একে সংগঠনে যুক্ত হন শ্রদ্ধেয় পি. হালদার, এইচ এম ইউসুফ, এম.এ. কুদ্দুস, কে.এ. রহিম, প্রাণ কৃষ্ণ সেন, সন্তোষ মুখার্জী, মহারাজ মন্ডল, নূর হোসেন, মহি উদ্দীন আহমেদ, সাবের আহমেদ, দিলীপ রায়, নিরঞ্জন মিস্ত্রী, ফরিদুল আলম জাহাঙ্গীর, তোফায়েল আহমেদ, আশীষ দাশ গুপ্ত সহ আরো অনেক স্বনামধন্য শিক্ষক।
মরহুম এম.এ. গফুর অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারতেন । বেসরকারি শিক্ষকদের প্রতি রাষ্ট্রের অবহেলা ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সর্বদা সোচ্চার। প্রতিকুল পরিবেশেও জ্বালাময়ী অথচ জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দিয়ে শিক্ষকদের উদ্দীপ্ত করার ক্ষমতা ছিল তাঁর অসামান্য। ২০০২ সালের ৩০ নভেম্বর দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত পাকিস্তান এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ আমলে যত শিক্ষক আন্দোলন হয়েছে এম.এ. গফুর ছিলেন তার মূল প্রেরণাদাতা। সম্মুখ ভাগের সবচেয়ে সাহসী যোদ্ধা। তাঁর মত সত্যিকারের শিক্ষক দরদী নেতার জন্যই শিক্ষক সমিতি বরিশাল আঞ্চলিক শাখার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে। শিক্ষক যেখানে বিপদে বা সমস্যায় পড়েছে সর্বাগ্রে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। মরহুম এম.এ. গফুরের দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণেই বেহাত হওয়া সরকারি ডিডিপি.আই অফিস রক্ষা পেয়েছে। একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ও অসাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন শিক্ষাবিদ হিসেবে তিনি এই সংগঠনটিকে শিক্ষকদের অর্থনৈতিক দাবির গন্ডির মধ্যে শুধু সীমাবদ্ধ রাখেননি। শিক্ষক আন্দোলন ও সমস্যাগ্রস্থ দুঃস্থ শিক্ষকদের সহায়তায় বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের পাশাপাশি বরিশালের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের উল্লেখযোগ্য সব সংগঠনকে তিনি আর্থিক পৃষ্টপোষকতা করে গেছেন।
মরহুম এম.এ. গফুরের বর্তমান উত্তরসুরীগণ একই ধারা অব্যাহত রেখেছেন। করোণাকালীন সময়ে নন এম.পিও ভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শতাধিক শিক্ষক কর্মচারিকে লক্ষাধিক টাকা আর্থিক সাহায়তা প্রদান করা হয়েছে। করোণা সতর্কতা এবং করণীয় সম্পর্কে পঞ্চাশ হাজার লিফলেট শুরুতেই বিলি করা হয়। অবসর প্রাপ্ত শিক্ষকদের সম্মাননা জানাতে প্রতি বছর আয়োজিত হয় বিশাল অনুষ্ঠানের। গত বছর এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বরিশালের মাননীয় মেয়র মহোদয়। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে মাসব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। গত বছর ৩০ নভেম্বর মাসব্যাপী সমাপ্তি অনুষ্ঠান হয়েছিল অশ্বিনী কুমার হলে যেখানে মাননীয় মেয়র মহোদয়সহ বরিশালের শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, সাংবাদিকতা অঙ্গনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। প্রাক্তন সফল সভাপতি এম.এ. গফুরের মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে মাসব্যাপী অনুষ্ঠানেও থাকে শিক্ষার্থীদের প্রতিযোগিতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি। ২০২০ সালে মুজিব বর্ষে ৩০টির অধিক আইটেম নিয়ে জাতির জনকের জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা নিয়ে একগুচ্ছ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল। করোণার প্রকোপ বৃদ্ধির জন্য যার অনেকটা স্থগিত রাখা হয়। শিক্ষক সমিতিতে যে ধরনের কর্মকান্ড চলে বরিশালে কেন, সারা দেশেও এ ধরনের কর্মকান্ড নজরে পড়ে না। গত ৫ বছর ধরে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিক, সংস্কৃতিসেবি, উন্নয়ন সংগঠকদের নিয়ে চলছে শিক্ষা বাজেট নিয়ে মনোজ্ঞ সেমিনার, গোলটেবিল আলোচনা। গত বছর সহ ৩ বার এ ধরনের অনুষ্ঠান হয় টাউন হলে। বাকি ২ বছর সেমিনার অনুষ্ঠিত হয় অক্সফোর্ড মিশন স্কুলের অডিটরিয়মে।
শিক্ষকদের নিয়ে ভাবনার সাথে সাথে শিক্ষা, শিক্ষার্থী এবং দেশ নিয়ে শিক্ষক সমিতি যেমন চলছে ভবিষ্যতেও এমন ধারা অব্যাহত থাকবে। অব্যাহত থাকবে এই সংগঠনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষা ধারা।

দাশগুপ্ত আশীষ কুমার
প্রধান উপদেষ্টা
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি
বরিশাল আঞ্চলিক শাখা

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর

ফেসবুক কর্নার

শিরোনাম
আইপিএল ছেড়ে দেশে ফিরতে হবে মুস্তাফিজকে!ইডেনের গ্যালারিতে বসেই ধূমপান, প্রবল সমালোচনআরো ১১৮ বুদ্ধিজীবীর তালিকা দিল মুক্তিযুদ্ধ মঢাকার বস্তির বেশিরভাগ মানুষ বরিশালেরভারতে উত্তর প্রদেশে মাদ্রাসা বন্ধের নির্দেশ সৌদি আরবে চাঁদ দেখা গেছে, মঙ্গলবার বাংলাদেশে ভারতকে হারিয়ে শিরোপা জিতলো বাংলাদেশপুরো রমজান মাস বন্ধ থাকবে প্রাথমিক-মাধ্যমিক প্রাথমিক শিক্ষকদের অনলাইনে বদলি শুরু চলতি মাভুটানকে ৬-০ গোলে উড়িয়ে দিল মেয়েরাপাকিস্তানে ইমরান খানের জেলে হামলা, আটক ৩জাতির পিতা সংবিধানে নারীদের অধিকার নিশ্চিত কপিরোজপুরে ত্রিমুখী সংঘর্ষে নারী-শিশুসহ নিহত মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতার ফাইনালে বাংলাদেশইতিহাস মুছে ফেলা যায় না, আজকে সেটাই প্রমাণিত:
%d