বরিশাল ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ১৭ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি
কে এম সবুজ, ঝালকাঠি ॥
কিশোর বয়সেই মন্ডপে প্রতিমা তৈরি করে সারা ফেলেছেন ঝালকাঠির বিধান কুমার দাস (১৪)। তাঁর নিপুন হাতের ছোঁয়ায় মৃম্ময়ী প্রতিমা ধীরে ধীরে দেবী রূপ ধারণ করছে। প্রতিভাবান হতে কোন বয়সের প্রয়োজন হয় না, তার জ্বলন্ত উদাহরণ বিধান।
জানা যায়, সদর উপজেলার বাসন্ডা ইউনিয়নের কুনিহাড়ি গ্রামের বিমল কুমার দাস ও অঞ্জলী রানীর ছোট ছেলে বিধান এ জেলায় প্রতিমা তৈরির সর্ব কনিষ্ঠ কারিগর। প্রাথমিক শিক্ষার গন্ডি পেড়িয়ে ২০১৭ সালে ঝালকাঠি পৌর আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হলেও অর্থাভাবে বিধানের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। ওই বছরই ঝালকাঠি শহরের কালীবাড়ি পূজা মন্ডপে প্রতিমা তৈরির কাজ দেখে আকৃষ্ট হয়। তাঁর মনে সাধজাগে, সেও প্রতিমা তৈরির কারিগর হবে। কোনো ওস্তাদ না ধরেই বাড়িতে এসে মাটি দিয়ে চেষ্টা করতে থাকে প্রতিমা তৈরির কাজ। পরের বছর ২০১৮ সালে নিজের ঘরের বারান্দায় মাটি দিয়ে তৈরি করে দুর্গাপ্রতিমা। তাঁর প্রতিভা দেখে অবাক হয় মা-বাবা ও স্বজনরা। পরের বছর ২০১৯ সালে বাড়ির আঙিনায় দুর্গা মন্ডপ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় বিধানের স্বজন ও প্রতিবেশীরা। ছোট পরিসরে তা বনিয়ে পূজা অর্চণার কাজ শুরু করেন।
এবছর সরকারের তালিকায় নাম ওঠে বিধানের বাড়ির পূজা মন্ডপটি। গত দুই মাসের প্রচেষ্টায় বিধান তৈরি করলো দুর্গা, কার্তিক, গনেশ, মহিঅসুর, লক্ষ্মী ও স্বরস্বতীর প্রতিমা। কিশোর বিধানের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় মৃন্ময়ী প্রতিমা ধীরে ধীরে দেবী রুপ ধারণ করছে। অল্প দিনের মধ্যেই শুরু হবে বাহারী রংয়ের কাজ। রং তুলির কাজটিও নিজের হাতে করবে বিধান। পাল বংশের সন্তান না হয়েও বিধান দাস যে প্রতিমা তৈরি করেছে তা দেখে হতবাক স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। ঝালকাঠি সদর উপজেলার বাসন্ডা ইউনিয়নের কুনিহাড়ি গ্রামের হাওলাদার বাড়ির পূজা মন্ডপে স্থাপন করা হচ্ছে বিধানের তৈরি প্রতিমা। বিধানের প্রতিমা তৈরির কাজ দেখতে ঝালকাঠি শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে হিন্দু ধর্মালম্বীরা ভীড় জমাচ্ছেন হাওলাদার বাড়ির পূজা মন্ডপটিতে।
মন্ডপ কমিটির সভাপতি উত্তম চন্দ্র বলেন, বিধানের আত্মবিশ্বাস ও সাহস দেখে আমরা হতবাক। তাঁর প্রতিভা সত্যিই প্রসংশনীয়।
মন্ডপ এলাকার বাসিন্দা আলো রানী বলেন, কোন ডাইস বা খর্মা ছাড়াই ছেলেটি নিজ হাতে কার্তিক, গনেশ, লক্ষ্মী, স্বরস্বতী, মহিঅসুর ও দুর্গা মায়ের মুখমন্ডল তৈরি করেছে, যা অভাবনীয়।
একই গ্রামের হরি নাথ বলেন, আয় কমে যাওয়ায় বর্তমানে প্রতিমা তৈরির কারিগররা চলে যাচ্ছে অন্য পেশায়, এ মুহূর্তে শখের বসে হলেও বিধান দাসের এই কাজের দক্ষতা দেখে মনে হচ্ছে ওর প্রতি এ যেনো খোদ ঠাকুরের আশির্বাদ।
বিধানের বাবা বিমল কুমার দাস (৫২) বলেন, তিনি আগে বেকারীতে চানাচুর তৈরির কাজ করতেন। বর্তমানে শ্বাসকষ্ট থাকায় কাজ ছেড়ে বাড়িতে বেকার দিন কাটছে। বড় ছেলে বিজয় একটি স্টুডিওতে কাজ করে। দুই সন্তানের মধ্যে বিধানই হচ্ছে ছোট। ছেলেটিকে অর্থাভাবে পঞ্চম শ্রেণির পর পড়ালেখাও আর করাতে পারিনাই। কিন্তু সে যখন যা দেখে সেটা খুব অল্প সময়ে আয়ত্ব করে ফেলে। ঠাকুর তৈরিতে তাঁর নিঁখুত কাজ সত্যিই অসাধারণ। আমি চাই আমার এই ছেলেটি পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে অনেক দুর এগিয়ে যাক।
বাসন্ডা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোবারক হোসেন মল্লিক বলেন, কিশোর বয়সে তাঁর প্রতিভা এতই নিখুঁত, পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ভবিষ্যতে সে অনেক বড় কারিগর হতে পারবে। আমি ইতোমধ্যে অর্থিক সহায়তা করেছি। আমি দীর্ঘদিন অসুস্থ। আমার শরীর সুস্থ হলে আমি মন্ডপটি দেখতে যাবো। বিধানের জন্য ভালবাসা রইলো।
বিধান দাস জানায়, আমি নিজ হাতে দেবী দুর্গা মাকে বানাবো, এটা আমার শখ ছিলো। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা ও সকলের আশির্বাদে আজ আমি সফল হয়েছি। আমি আগামীতে আরো দু-একটি মন্ডপে প্রতিমা তৈরির কাজ করতে চাই।