বরিশাল ১২ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৮শে ভাদ্র, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১৯শে রবিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি
এ যেন উত্তমকুমার-সুচিত্রা সেন আর ছবি বিশ্বাস অভিনীত ‘সবার উপরে’ সিনেমার গল্পের মতোই। নির্দোষ হয়েও ১২ বছর জেলের সাজা ভোগার পর আদালতে দাঁড়িয়ে ছবি বিশ্বাসের সেই আর্ত আবেদন ‘মিথ’ হয়ে গিয়েছে বাংলা সিনেমার ইতিহাসে। ‘দাও, ফিরিয়ে দাও, ফিরিয়ে দাও আমার সেই ১২টা বছর’। বাস্তবতা রুপালি পর্দার চেয়ে অনেক কঠিন। সেই বাস্তবের বৃদ্ধ হাবিবুর রহমন বেসরকারি একটি উন্নয়ন সংস্থার চেক ডিজঅনার মামলায় ৪ অক্টোবর থেকে জেল খেটছেন।
হাবিবুর রহমান অপরাধী নন, তবুও তিনি জেল খাটছেন। কারণ মিলটা শুধু নামেই। ‘অপরাধ’ বলতে সেটাই। আর সেই অপরাধে সাত দিন জেলে রয়েছেন বৃদ্ধ হাবিবুর রহমান। বাবাকে জেল থেকে ছাড়ানোর জন্য প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন ছেল আবু সালেহ। টাকাও যোগাড় করতে পারছেন না ছেলে। তবে পুলিশের দাবি, মানুষ মাত্রই ভুল হয়। তাই দারোগারও ভুল হয়েছে। হাবিবুর রহমানকে জেলমুক্ত করতে পুলিশ কাজ করছে। ইতোমধ্যেই প্রকৃত দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে খুজে বের করতে পুলিশ অভিযান অব্যহত রেখেছে।
ঘটনাটি ঘটেছে সাগরতীরের পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলা শহরের কলেজ রোডস্থ বনানী এলাকায়। পুলিশ বলছে, গলাচিপা থানা সংলগ্ন সদর রোডের নাহার গার্মেন্ট মালিক হাবিবুর রহমান। পৌর শহরের বাসিন্দা নূর মোহাম্মাদ মাস্টারের ছেলে তিনি। তার বিরুদ্ধে চেক ডিজঅনার মামলায় এক বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। রায়ের পর সে পলাতক ছিল। ওই মামলায় গত ৪ অক্টোবর শুধুমাত্র নামের মিল থাকায় গলাচিপা বনানী এলাকার ৮০ বছরের বৃদ্ধ হাবিবুর রহমানকে তার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে পটুয়াখালী কারাগারে পাঠায়। নূর মোহাম্মাদ পণ্ডিতের ছেলে হাবিবুর রহমান সেই থেকে বিনা দোষে কারাভোগ করছেন।
মামলার নথি থেকে জানা গেছে, গলাচিপা থানা সংলগ্ন সদর রোডের নাহার গার্মেন্ট মালিক হাবিবুর রহমান। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্রাক থেকে ২০১২ সালের ৬ আগস্ট ১ লাখ ২০ হাজার টাকা ঋণ গ্রহন করেন। এ সময় তিনি ব্রাকের অনুকুলে উত্তরা ব্যাংক গলাচিপা শাখায় তার নিজস্ব একাউন্টের (হিসাব নং ২২০০) ঋণের সমপিরমান অর্থের একটি চেক জমা দেন। কিন্তু তিনি ওই ঋণ যথাসময়ে পরিশোধ না করায় ব্রাক কর্তৃপক্ষ হাবিবুর রহমানের জমাকৃত চেকটি পরবর্তী বছরের ১০ এপ্রিল ওই ব্যাংকে জমা দেন। হিসাবে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় তা ডিজঅনার হয়।
পরবর্তীতে ঋণ গ্রহীতা হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ব্রাক কর্তৃপক্ষ আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় পটুয়াখালীর যুগ্ম দায়রা জজ জিন্নাৎ জাহান ঝুনু ২০১৮ সালের ২৫ মার্চ রায় দেন। রায়ে হাবিবুর রহমানকে এক বছরের কারাদণ্ড ও ঋণের দ্বিগুন অর্থ অর্থাৎ ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের আদেশ দেন। রায়ের দিন ঋণ গ্রহীতা হাবিবুর রহমান আদালতে অনুপস্থিত থাকায় আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।
ওই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা অনুযায়ী গলাচিপা থানার সহকারি পরিদর্শক (এএসআই) আল-আমিন গলাচিপা বনানী এলাকায় গত ৪ অক্টোবর অভিযান পরিচালনা করেন। শুধুমাত্র নামের মিল থাকায় ৮০ বছরের বৃদ্ধ হাবিবুর রহমানকে তার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করেন। ওইদিন বিকেলে তাকে আদালতের মাধ্যমে তাকে পটুয়াখালী কারাগারে পাঠানো হয়।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, প্রকৃত ঋণ গ্রহীতা হাবিবুর রহমান প্রায় ৫ বছর আগে গলাচিপা থানা সংলগ্ন সদর রোড থেকে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গুটিয়ে ফেলেন। পার্শ্ববর্তী মহিলা কলেজ সড়কে নতুন করে মুদি-মনোহরি ব্যবসা শুরু করেছেন তিনি। শনিবার দুপুরে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ পাওয়া গেছে। স্থানীয়রা বলছেন, গত ৪ অক্টোবরের পর থেকেই হাবিবুর রহমান তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আসছে না।
এ ব্যাপারে বিনা দোষে কারাগারে থাকা হাবিবুর রহমানের স্ত্রী আনোয়ারা বেগম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার স্বামী কোনো দিন ব্যবসা করেননি, আর আমরা কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণও নেইনি। আমাদের দুই ছেলে ঢাকায় গার্মেন্টে চাকরি করে। আমাদের ভরণ-পোষণের জন্য প্রতি মাসে তারা যে টাকা দেয় তা দিয়ে আমাদের দুজনের চলে যাচ্ছে। পুলিশকে বিষয়টি বলেছি কিন্তু তারা শোনেনি।’
হাবিবুর রহমানের ছোট ছেলে আবু সালেহ জানান, আমার বাবাকে কারাগারে পাঠানোর সংবাদ পেয়ে আমি ঢাকা থেকে চলে আসি। আদালত থেকে কাগজপত্র ওঠানোর পর দেখি আমার বাবা নিরপরাধী। শুধুমাত্র নামের মিল থাকার কারণে সাজাপ্রাপ্ত অন্য লোকের পরিবর্তে আমার বাবাকে পুলিশ কারাগারে পাঠিয়েছে। আমার বাবা অসুস্থ, চোখেও ভাল দেখতে, কানে ভালো শুনতে পান না। এমনকি তার চলাচলের তেমন শক্তিও নেই।
গলাচিপা থানার উপসহকারি পরিদর্শক (এএসআই) আল-আমিন বলেন, ‘আদালত থেকে একটি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠাই। কিন্তু পরে জানতে পারি তিনি প্রকৃত আসামি নন। বিষয়টি দুঃখজনক এবং আমার ভুল হয়েছে। তবে নিরপরাধী ওই বৃদ্ধকে জেল থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছি।’
গলাচিপা থানার ওসি মনিরুল ইসলাম জানান, আসামির নাম ও পিতার নামে মিল থাকায় সরল বিশ্বাসে এএসআই আল-আমিন তাকে গ্রেপ্তার করে। বিষয়টি আমরা সংশোধন করে ইতোমধ্যে চিঠি পাঠিয়েছি এবং ওই বৃদ্ধকে দ্রুত কারামুক্ত করার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কলের কন্ঠ